মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি:
জেলার ১৪ জন নারী উদ্যোক্তাকে পিছনে ফেলে অদম্য নারী উদ্যোক্তা লাবনী আক্তার মানিকগঞ্জ থেকে বুটিক “ডিফারেন্ট বিউটি” মানিকগঞ্জ হ্যান্ডিক্রাফট “UNCDF” ‘জাতীসংঘের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিজনেসের জন্য অফেরতযোগ্য ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকার অনুদান দেয়া হয়’।এটা শুধু টাকাই না একটা জাতীয় স্বীকৃতি।উদ্যোক্তা যাতে তার ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করতে পারে।
লাবনীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা মানিকগঞ্জ জেলা সদরের বান্দুটিয়া। মানিকগঞ্জ জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এস কে গার্লস হাই স্কুল থেকে এস এস সি পাশ ও সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশের পরে অর্থনীতিতে অনার্স মাস্টার্স এবং প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে ফিন্যান্স এ এম.বি.এ করেছেন।
ব্যবসা শুরুতে যে পুঁজি : ব্যবসার শুরুটা হয়েছিলো সাতশ টাকা দিয়ে। প্রথমদিকে শখের বসে কুশন কভারে হাতের কাজ এবং পরবর্তীতে জামার কাজ করে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। অল্প সময়েই অধিক জনপ্রিয়তা তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত ২০২২ এ মানিকগঞ্জ সদর থেকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে পুরষ্কৃত হন তিনি।
জানা যায়, লাবনী আক্তার জেলার প্রথম সারির একজন নারী উদ্যোক্তা যিনি নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিচিতি লাভ করেছেন।
জাতীসংঘের অনুদান সম্পকে বলেন, এটা এককালিন একটা পেমেন্ট যা ব্যবসা সম্প্রসারণ করার জন্য দেওয়া হয়েছে। অনুদান পাওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্তাবলি আছে।ইউ এন অফিস থেকে ভিজিটে এসে তদন্ত করে সরজমিনে । শর্তাবলির মধ্যে অন্যতম ৫০% নারী কর্মী থাকে হবে।আমার টা ১০০% নারী কর্মী দ্বারা পরিচালিত ও বিগত ৩ বছরের সেল তারা দেখেছে। আমার ছোট্ট বুটিক ডিফারেন্ট বিউটি র শুরুটা ছিলো খুব অল্প পরিসরে। আপনাদের দোয়ায় এতদুর আসতে পেরেছি আজ। বিজনেস যদিও আমি নিজের চেষ্টায় এত দূর আনতে পেরেছি কিন্তু ইউ এন এর অনুদানের ফর্মটা হাতে পেয়ে বাংলা লিখাগুলোও বুঝতে পেরেছিলাম না যে কিভাবে এটা পুরন করতে হবে। মানিকগঞ্জ বিসিকের উপপরিচালক মাহবুবুল ইসলাম রোকন স্যার এর সহযোগিতায় ও প্রসেসিং এর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আমার বিজনেসের সকল এনালাইসিস নতুন করে জেনেছি যা ভবিষ্যতে আমার বিজনেস সম্প্রসারনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইউ এন থেকে যারা ভিজিটে এসেছিলেন তাদের বিসিক থেকে বিসিক নিবন্ধিত উদ্যোক্তা হিসেবে আমার বুটিক সম্পর্কে একটা ফলপ্রসু ধারনা দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে যখন ইউ এন থেকে আমার শোরুম, কারখানা ভিজিটে আসেন এবং আমার কর্মীদের সাথে কথা বলেন তারা আমার এই উদ্যোগ কে অনেক বেশী পছন্দ করেন। শতভাগ নারীকর্মী দ্বারা পরিচালিত আমার প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিতে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেন। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় এই অনুদান পাওয়ার জন্য অনেকে মিথ্যার আশ্রয় বা শিখানো পড়ানো থাকে তার জন্য এই তদন্ত ।তাদের সকল শর্ত পূরন হয়েছে এ জন্য তারা অনেক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছে অনুদানের ক্ষেএে এটা সাকসেসফুল একটা বিজনেসকে আরও সম্প্রসারণ করার জন্য দিয়ে থাকে।অনুদানের ৫ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে ৫০% টাকা হাতে পেয়েছি বাকিটা খুব দ্রুত পেয়ে যাবো। সকলের দোয়া কামনা করছি এই অনুদানের সঠিক ব্যাবহার দ্বারা যেনো আমি আমার বিজনেস কে আরও এগিয়ে নিতে পারি।আরও বেশি নারীদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারি।
লাবনী আক্তার বলেন, সামাজিক ব্যবস্থায় নারীরা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে নারীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেন না। ইচ্ছে আছে নারীদের কল্যাণে, সহায়তায় ও প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করার।
প্রথমদিকে,নিজের স্বল্প পুঁজি খাটিয়ে ২ জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। বর্তমানে ১০০ নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পেরেছি। জাতিসংঘের আর্থিক সহযোগিতায় এখন হয়তো নারীদের উন্নয়নে আরেকটু এগোতে পারব। সমাজের পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, নির্যাতিত নারীদের নিয়ে সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই। তাদের স্বাবলম্বী করতে চাই। আর এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমার এই পথচলা অব্যাহত থাকবে।বুটিকস আরও বড় করবো ইনশাআল্লাহ। নারীদের কর্মসংস্থান করে তাদের সাবলম্বি করে তুলবো এবং দেশিয় পন্যকে আধুনিক রুপে সারা বিশ্বে তুলে ধরবো।
তিনি আরও বলেন, ২০১৫ এর শুরুতে শুধু অনলাইন ভিত্তিক ছিলো কিন্ত পরবর্তীতে বিজনেস অনেক ভালো অবস্থানে আসে। আমি ঢাকা থাকতাম। মানিকগঞ্জ এসে কাজ করিয়ে আবার ঢাকায় নিতাম। কিন্তু ২০১৮ তে হাতের কাজের পন্যের চাহিদা অনেক বাড়ে এ জন্য মানিকগঞ্জ চলে আসি ২০১৮ তে ট্রেড লাইসেন্স করি। ২০১৯ এ দিঘী ইউনিয়নের মুলজানে শোরুম এবং কারখানা করি।
লাবনী আক্তারের ফেসবুক পেইজ ‘ডিফারেন্ট বিউটি’ ভোক্তাদের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী পণ্য এনে থাকে। পণ্যের মধ্যে রয়েছে হাতের কাজের শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি পিচ, ওয়ালম্যাট, ইত্যাদি।
দাম ও মানের কারণে অনলাইনের পাশাপাশি নিজ এলাকা মুলজানে তিনি সাধারণের কাছে অল্প সময়ে ভালো অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ থেকে ৮ বছর আগে ব্যবসায়ের মুলধন ৭০০ টাকা হলেও বর্তমানে তার ব্যবসায়ের মূলধন বহুগুণে বেড়েছে। নিজস্ব পরিমণ্ডলে তিনি এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনভাবে কাজ করে মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর চিন্তা থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা।
একজন উদ্যোক্তার প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো স্বপ্ন দেখা। একজন ব্যবসায়ী ও একজন উদ্যোক্তার মধ্যে এটাই পার্থক্য। আমার নিজের উদ্যোগে কিছু করার ইচ্ছা ছিলো।আর পড়াশুনা শেষ করে জবের দিকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। আমার বাচ্চা দেখাশোনার কেউ ছিলো না। বাচ্চাদের দেখাশোনার পাশাপাশিই নিজ উদ্যোগে কিছু করার কথা ভেবেই উদ্যোক্তা হওয়া। স্বপ্নবাজ লাভনী তার মনের লালিত স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার কারন সম্পর্কে লাবনী আক্তার বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল একজন উদ্যোক্তা হওয়ার। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। শুরুটা অনেক সহজ ছিলো না। মানুষের তিরস্কারই বেশি পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি আমি পারবো।আমি আমার কাজের মাধ্যমে আস্তে আস্তে আমার বিজনেসকে একটা পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ে আসার পরে আমার হাজব্যান্ড এর সাপোর্ট পেয়েছি। পড়াশুনার পাশাপাশি নিজে কিছু একটা করার দৃঢ় ইচ্ছে থেকেই মাথায় আসে অনলাইন ব্যবসার প্ল্যান। তবে এ কাজে সেই সঙ্গে পরর্বতীতে সবার সাপোর্টের কথাও জানান তিনি।
বর্তমান ব্যবসার অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ভালো কেনাবেচা চলছে। মানিকগঞ্জের কর্মী দিয়ে কাজ করানো হয়। আমি এমন কাপড় সেল করি না যার কারনে মানিকগঞ্জের বদনাম হয়। তবে সারা বাংলাদেশে ৬৪ জেলায় আজ আমার বুটিকের হাতের কাজের প্রডাক্ট এর জন্য মানুষ মানিকগঞ্জ কে চিনে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানিকগঞ্জে আমার বুটিক সম্পর্কে প্রচার প্রসার একদমই নেই। নিজ জেলার থেকে অন্যান্ন জেলা গুলোতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তার অনলাইন পেজ ‘ডিফারেন্ট বিউটি’। ভবিষ্যতে তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে আরও প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান।
নতুন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আমার পরামর্শ- সৃজনশীল কাজে আগ্রহ থাকলে শিক্ষিত হয়ে চাকরির আশায় বসে না থেকে ভিন্নধর্মী পেশা বা ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে খুব সহজেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়া যায়। ব্যবসায়িক বুদ্ধি, রুচিবোধ, গ্রাহকের মানসিকতা ও সৃজনশীলতা থাকলে যে কেউ হতে পারেন একটি বুটিক হাউসের কর্ণধার। স্বাবলম্বী হয়ে বেঁচে থাকার স্বার্থকতাটাই আলাদা। তাই বলবো, একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হলে আপনাকে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে হবে। প্রতিবন্ধকতা থাকবেই, তবে ইচ্ছা থাকলে তা ওভারকাম করা সম্ভব। স্বপ্ন, সামান্য পুঁজি আর পরিশ্রম থাকলেই অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া যায়। ‘ভবিষ্যতে আমার ‘ডিফারেন্ট বিউটি র প্রোডাক্ট সারাদেশসহ বিদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই।’