শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ন
বিজ্ঞপ্তি:
অনলাইন নিউজ পোর্টাল “আজকের তরুণকণ্ঠে” জেলা, উপজেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে সাংবাদিক/প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। আগ্রহীরা  ইমেইলে (newstarunkantho@gmail.com) জীবন বৃত্তান্তসহ পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও জাতীয় পরিচয় পত্র সংযুক্ত করে পাঠাতে পারেন।

ডলার-সংকটের শেষ কোথায়?

তরুণকণ্ঠ ডেস্ক
প্রকাশ : বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৪:৪৪ পূর্বাহ্ন
ডলার-সংকটের

বর্তমানে বাজারে মার্কিন ডলারের একধরনের সংকট চলছে। ফলে বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। অবশ্য এই প্রবণতা যে এখনই শুরু হয়েছে তা নয়, করোনা-পরবর্তী সময়ে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। দেশের অর্থনীতিতে যখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন মার্কিন ডলারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ফলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন শুরু হয় এবং এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। একসময় দেশের আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়ে। কিন্তু তার পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমে যায় এবং রপ্তানি আয়ও কমতে শুরু করে। চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দেয়। একই সময়ে আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে দেশকে দ্বিমুখী সমস্যায় পড়তে হয়।

অতীতে বাংলাদেশে কখনোই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়নি। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দেওয়ার বড় কারণ ছিল, যখন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়, তখন ব্যক্তি খাতের বড় বড় ব্যবসায়ীকে রিজার্ভ থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মূল্য কমে যাওয়ার কারণে এখানে দায় অনেক বেড়ে যায়। ঋণগ্রহীতারা দ্রুত এই ঋণের কিস্তি পরিশোধের চেষ্টা করে। প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের কিস্তি হিসেবে পরিশোধ করা হতে থাকে। এটা চলতি হিসাবের ভারসাম্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অবচয়ন ঘটে, এটা কেন ঘটল তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে। যদিও আমরা নীতিগতভাবে ভাসমান মুদ্রানীতি অনুসরণ করছি, কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলো সব সময়ই ম্যানেজড ফ্লোটিং সিস্টেম অনুসরণ করে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য বাজার থেকে মাঝে মাঝে উদ্বৃত্ত মার্কিন ডলার ক্রয় করত। আবার কখনো বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য মার্কিন ডলার বিক্রি করত। ফলে বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার মোটামুটি স্থির ছিল।

যখন রিজার্ভ-সংকট শুরু হলো, তখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ধরে রাখতে পারল না। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু তারও একটি নিয়ম আছে। নিয়মটি হচ্ছে, এ রকম স্বল্পকালীন বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখবেন আর দীর্ঘ সময়ের জন্য আস্তে আস্তে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এই কাজ করেনি। তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করেছে। করোনাকালীন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে। সেই সময় যদি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিনিময় হারের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিরপীতে মার্কিন ডলারের মূল্য আরো অনেক কমে যেত। আবার একসময় ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যেত। আজকে হয়তো প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ১০০ টাকা হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল কৌশলের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে গেছে, যা এখন সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সেটা না করার কারণেই আজকের এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যখন বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়, তখন কোনো কোনো মহল থেকে বেশ উল্লাস প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো দক্ষতার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা করা উচিত ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কখনোই অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বেশ কিছু অর্থ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে, যে অর্থ এখন আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ’৯০-এর দশকে যখন পূর্ব এশিয়ায় কারেন্সি ক্রাইসিস শুরু হয়, তার মূলে ছিল শর্ট টার্ম লোন। বর্তমানে আমরা যে রিজার্ভ-সংকট প্রত্যক্ষ করছি, তার পেছনে ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা কিছুটা দায়ী।

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আইএমএফ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আইএমএফ বলছে, যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে আছে এবং চাইলেই তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রিজার্ভ থেকে যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটাও রিজার্ভের অংশ। এই দুই পদ্ধতির মধ্যে খুব একটা সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয় না। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কীভাবে হিসাব করা হলো, সেটা আমার কাছে বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় বা উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। এখনো রিজার্ভ বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

অনেকেই বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সরাসরি মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। মুদ্রার বিনিময় হার সরাসরি মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেওয়ার অর্থ যদি হয় এমন যে ব্যাংকগুলো যেভাবে ইচ্ছা মুদ্রার মূল্যমান নির্ধারণ করবে, তাহলে সেটাকে মার্কেট বেইজড বলে না। কালোবাজারি বা ফটকা ব্যবসায়ীরা কী করল, তার ওপর ভিত্তি করে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করা হলে সেটা খুব একটা ভালো ফল দেবে না। বর্তমানে যেভাবে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করা হচ্ছে, এটাও মোটামুটি বাজারভিত্তিক বলা যেতে পারে। অর্থনীতির অন্যান্য যে মৌলিক সূচকগুলো আছে, তার সঙ্গে সমন্বয় রেখেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে।

আমি সম্প্রতি বিআইডিএসের সভায় একটি পেপার উপস্থাপন করেছি। সেখানে দেখিয়েছি, বর্তমানে ব্যবসায়ীরা প্রতি মার্কিন ডলার ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় ক্রয় করে এলসি খুলছে। অন্যান্য সূচকের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা যদি বিবেচনা করি, তাহলে মনে হবে খোলাবাজারে যে রেট চলছে, তা মোটামুটি মার্কেট রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাফেদা যে রেটের কথা বলছে, সেটা প্রকৃত রেট নয়। সেটা কৃত্রিম রেট। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি মার্কিন ডলার ১১০ থেকে ১১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটা বাজারের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২০ বা ১২৫ টাকা স্বীকার করে না। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২০ বা ১২৫ টাকা স্বীকার করে, তাহলে কার্ব মার্কেটে প্রতি মার্কিন ডলার ১৩০ টাকা বা তারও বেশি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দক্ষতার সঙ্গে সঠিক নজরদারি করে, তাহলে বাজারে প্রতি মার্কিন ডলার ১২০ বা ১২৫ টাকায় পাওয়া যাবে। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, তাতে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২০ বা ১২৫ টাকা যৌক্তিক।

অন্যান্য দেশ যেভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, আমরা তা করতে পারিনি। বরং এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান—সব দেশেই মূল্যস্ফীতি ক্রমশ কমছে আর আমাদের এখানে বাড়ছে। আমরা সেই সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছি আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যে। আমরা ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে রেখেছি। অথচ ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে কমানো হয়নি।

এখন প্রশ্ন হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতির হাত থেকে দেশকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে? এর জন্য প্রথমেই বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককেই উদ্যোগ নিতে হবে। বাফেদা বা অন্য কোনো সংস্থাকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না। মুদ্রার বিনিময় হার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে গতিশীল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। স্বল্প সময়ের জন্য বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখবেন এবং দীর্ঘ মেয়াদে ধীরে ধীরে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে সঠিকভাবে মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে বাড়তে বা কমতে দিতে হবে। কৃত্রিমভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। অনেক দিন ধরেই ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। এখন কিছুটা উদারীকরণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই বছরে পলিসি রেট বেশ কয়েক বার বাড়িয়েছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারিত থাকায় তার সুফল পাওয়া যায়নি। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের অর্থ অন্য খাতে প্রবাহিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্তত ৭৭টি পলিসি রেট বাড়িয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারিত করে রাখার ফলে এই পদক্ষেপ উলটো ফল দিয়েছে।

লেখক: রিসার্চ ডিরেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস), ঢাকা।

অনুলিখন :এম এ খালেক


এ সম্পর্কিত

Theme Created By ThemesDealer.Com